গর্ভাবস্থায় হালকা চুলকানি হওয়া নিয়ে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই চিন্তার কিছু নেই। এটা খুবই স্বাভাবিক। প্রায় ২০ ভাগ গর্ভবতী মহিলার চুলকানির সমস্যা...
গর্ভাবস্থায় হালকা চুলকানি হওয়া নিয়ে
বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই চিন্তার কিছু নেই। এটা খুবই স্বাভাবিক। প্রায় ২০ ভাগ
গর্ভবতী মহিলার চুলকানির সমস্যা থাকে। এ সময় মায়েদের পেট এবং স্তনের
আশেপাশে চুলকানি বেশী হতে পারে, কারণ দুটো স্থানের চামড়াই এ সময় প্রসারিত
হয়। শুষ্ক ত্বক ও হরমোনের পরিবর্তনের কারণেও এ সময় চুলকানি দেখা দিতে পারে।
গর্ভাবস্থায়
চুলকানির কারন এখন পর্যন্ত কেউ তেমনভাবে বুঝে উঠতে পারেনি। তবে ধারনা করা
হয় যে এটির কারণ হতে পারে ত্বকে রক্ত সরবরাহের বৃদ্ধি এবং গর্ভকালীন কিছু
হরমোন। এই হরমোন শরীরে কিছু রক্তে, স্নায়ুতে ও চামড়ার নিচে প্রতিক্রিয়া
সৃষ্টি করে যার ফলে চুলকানির সৃষ্টি হয়। মায়ের শরীরে তখন অস্বস্তির সৃষ্টি
হয়।
ত্বকের কিছু সাধারন সমস্যা, যেমন –
একজিমার কারণেও চুলকানি হতে পারে। গর্ভাবস্থায় প্রথমবারের মত মায়ের ত্বকে
একজিমা দেখা দিতে পারে বা অনেক আগের একজিমার সমস্যা আবার ফিরে আসতে পারে।
যদি মায়ের একজিমা থাকে তবে গর্ভাবস্থায় এর অবনতি হতে পারে। একজিমার কারণে
সাধারনত মুখ, গলা ও বুকের ত্বক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এছারাও ত্বকের ভাজে, যেমন
হাঁটু ও কনুইয়ের ভাজেও একজিমা হতে পারে। তবে কিছু কিছু মায়েদের ক্ষেত্রে
দেখা যায় গর্ভাবস্থায় একজিমার উপসর্গ ভালো হয়ে যায়।
তবে
মনে রাখতে হবে, যদি চুলকানির সাথে সাতে র্যাশ দেখা যায়, হাতের ও পায়ের
তালুতে অনেক বেশী চুলকানি হয় তবে দ্রুত তা ডাক্তারকে জানাতে হবে কারণ এগুলো
মারাত্মক কোন সমস্যার লক্ষণ হতে পারে।
গর্ভাবস্থায় চুলকানিতে কিভাবে আরাম পাওয়া যাবে?
চুলকানি
হলে যত কম সম্ভব চুলকানোর চেষ্টা করুন। এতে ত্বক আরও ফেটে যেতে পারে এবং
ত্বকের ইনফেকশন দেখা দিতে পারে। যদি শুষ্ক এবং প্রসারিত চামড়ার কারণে
গর্ভাবস্থায় চুলকানি দেখা দেয় তাহলে নিচের পদ্ধতিগুলো আপনাকে আরাম দিতে
পারে।
চুলকানির সাথে ঠাণ্ডা পানির
দা-কুমড়া সম্পর্ক। যে স্থানে চুলকানির সমস্যা আছে সেখানে ঠাণ্ডা পানি দিয়ে
ধুতে থাকবেন। দেখবেন আস্তে আস্তে চুলকানি কমে যাবে। চুলকানির জায়গায় আইস
প্যাক বা ঠাণ্ডা পানিতে চুবানো কাপড় ৫-১০ মিনিট বা চুলকানি কমা পর্যন্ত
দিয়ে রাখতে পারেন।
ত্বক আদ্র রাখতে
ময়শ্চারাইজার ব্যাবহার করতে পারে। এগুলো সুগন্ধিযুক্ত না হলেই ভালো। একজিমা
থাকলে ডাক্তারের পরামর্শকৃত ক্রীম বা লোশন ব্যাবহার করতে হবে। যদি মনে হয়
আপনি ঘুমের মধ্যে চুল্কাচ্ছেন তবে ঘুমানোর সময় হাতে কটনের হাত মোজা পরে
নিতে পারেন।
তুলসী পাতায় আছে ইউজেনল যা
একটি অ্যান্সথেটিক উপাদান। এই উপাদানটি চুলকানি কমিয়ে দিতে সহায়ক। এক মগ
ফুটন্ত পানিতে ১৫/২০টি তুলসী পাতা জ্বাল দিয়ে নির্যাস বের করে নিন। এরপর
একটি পরিষ্কার টাওয়েলে পানিটি লাগিয়ে হালকা গরম থাকা অবস্থাতেই চুলকানির
স্থানে লাগিয়ে নিন। কিছুক্ষণের মধ্যেই বেশ আরাম অনুভূত হবে।
ত্বকের
যত্নে অ্যালোভেরার ব্যবহারের কথা তো সবাই জানেন। চুলকানি প্রতিকারেও
অ্যালোভেরার জুড়ি নেই। ত্বকের যে স্থানে চুলকানি হচ্ছে সেখানে একটি তাজা
অ্যালোভেরা পাতা থেকে রস বের করে লাগিয়ে রাখুন। চুলকানি কমে যাবে
কিছুক্ষণের মধ্যেই।
যদি আপনি সেনসিটিভ
ত্বকের অধিকারী হন তবে পেট্রোলিয়াম জেলি ব্যবহার করতে পারেন। এর কোন
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। শরীরের কোন অংশে চুলকানি হলে আপনি পেট্রোলিয়াম
জেলি ব্যবহার করতে পারেন। এটি সবার ঘরেই থাকে, ফলে যেকোন সময়ই আপনি এটি
ব্যবহার করতে পারবেন।
নারকেল তেল ত্বকে
ব্যবহারের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ পণ্য। যে কোন প্রকার চুলকানি, পোকার কামড় বা
অন্য কোন কারণে ত্বকে চুলকানি হলে যেখানে চুলকাবে সেখানে নারকেল তেল দিয়ে
দিন। যদি সম্পূর্ণ শরীরে চুলকানি হয় তবে পুরো শরীরে নারকেল তেল মাখতে
পারেন। কুসুম গরম পানিতে নারকেল তেল মিশিয়ে গোসলও করে ফেলতে পারেন।
গর্ভাবস্থায় কিভাবে চুলকানি প্রতিরোধ করা যায়?
গর্ভাবস্থায়
আপনি হয়তোবা চুলকানি পুরোপুরি প্রতিরোধ করতে পারবেন না। কিন্তু নিম্নলিখিত
উপায়ে হয়তোবা এর উপসর্গ আপনি কিছুটা কমাতে পারবেন।
গোসলের
পানি যাতে বেশী গরম না হয় সেদিকে খেয়াল রাখুন এবং গোসল যত দ্রুত সম্ভব শেষ
করার চেষ্টা করুন। এতে ত্বক আরও বেশী শুষ্ক হয়ে যেতে পারে এবং চুলকানি
বাড়তে পারে। গোসলের সময় মৃদু বা সুগন্ধিমুক্ত সাবান ব্যাবহার করুন এবং
সাবার ভালো ভাবে ধুয়ে নিন। গা মোছার সময় টাওয়েল দিয়ে খুব বেশী ঘষবেন না।
হালকা করে চেপে চেপে শরীর শুকিয়ে নিন।
খুব
বেশী গরমে না যাওয়ার চেষ্টা করুন। গরমের কারণে চুলকানি বাড়তে পারে।
চুলকানি রোধের জন্য ঢিলে জামাকাপড় পরা উচিত, এর ফলে আপনার জামাকাপড় আপনার
ত্বকের সঙ্গে কম ঘর্ষণের সম্ভাবনা থাকে। এছাড়াও আপনি সিনথেটিক কাপড়
ব্যবহার এড়িয়ে প্রাকৃতিক উপকরণে তৈরি যেমন সুতি ব্যবহার করার কথা ভাবতে
পারেন। এগুলো শ্বাস প্রশ্বাস বান্ধব হয় এবং আপনার ত্বকের কাছে বাতাসে
চলাচল করতে পারে।
কাপড়ের ধোয়ার জন্য
সুগন্ধি মুক্ত ডিটারজেন্ট ব্যাবহার করুন। কাপড় ধোয়ার কাজে গরম পানি
ব্যাবহার করতে পারেন। এবং ধোয়ার সময় সাবান ভালো ভাবে পরিষ্কার করে ফেলুন।
স্ট্রেস ও উদ্বেগ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করুন। এগুলোর কারণেও গর্ভাবস্থায় চুলকানি সমস্যা দেখা দিতে পারে।
কখন ডাক্তারের কাছে যেতে হবে?
সাধারণত
হালকা চুলকানি সম্পর্কে চিন্তা করার কিছুই নেই, কিন্তু যদি চুলকানি তীব্র
হয়ে উঠে, তবে এটি অবস্টেট্রিক কোলেস্টাসিস (ওসি)নামক একটি সমস্যার লক্ষণ
হওতে পারে, যা লিভারের একটি অবস্থাকে বঝানো হয়৷ এই রোগ ১০০ জনের মধ্যে ১ জন
গর্ভবতী মহিলাদের হয়ে থাকে, এবং তাদের চিকিৎসার আওতায় আনা দরকার।
অবস্টেট্রিক
কোলেস্টাসিস (ওসি) একটি সম্ভাব্য মারাত্মক লিভার ব্যাধি যা গর্ভাবস্থায়
দেখা দিতে পারে। সাধারণত, পিত্ত লবণ যা আপনার যকৃত থেকে পাকস্থলীর দিকে
প্রবাহিত হয়ে অন্ত্রের খাবার হজম করতে সাহায্য করে। অবস্টেট্রিক
কোলেস্টাসিসের ফলে পিত্ত লবণ সঠিকভাবে প্রবাহিত হতে পারে না এবং আপনার
শরীরের জমা হতে থাকে।এর কোন প্রতিকার নেই, তবে শিশু জন্মদানের পর এটি ঠিক
হয়ে যায়।
পরিবারিক ইতিহাস থাকলে,বা
পরিবারিক ইতিহাস ছাড়াও এটি হতে পারে। আপনার আগের গর্ভাবস্থায় ওসি হয়ে
থাকলে, পরবর্তী গর্ভাবস্থায় আবার তা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে, ওসি সঙ্গে নারীদের শিশুরা অকালজাত
অথবা মৃত জন্ম নিতে পারে। তবে এটা নিশ্চিত নয় যে যেসব নারীদের ওসি নেই
তাদের শিশু মৃত্যুর ঝুঁকি কতটুকু বেশি।এমন কোন নির্ভরযোগ্য উপায় নেই যেখান
থেকে আপনার শিশুর পৃথক ঝুঁকি পরিমাপ করা সম্ভব।
যদি আপনার গর্ভাবস্থায় ওসি থাকে তবে আপনার শিশু গর্ভে মৃত হওয়ার ঝুঁকি থাকে বলে ৩৭ সপ্তাহ পর স্বাভাবিকভাবে বা সিজারিয়ান সেকশন এর সাহায্যে ডেলিভারির প্রয়োজন হতে পারে।
ওসির লক্ষণ
অবস্টেট্রিক কোলেস্টাসিসের লক্ষন সাধারনত গর্ভাবস্থার ৩০ সপ্তাহের দিকে দেখা দিতে পারে তবে তার আরও অনেক আগে, এমনকি ৮ সপ্তাহের মধ্যেও দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
মারাত্মক
এই ব্যাধির প্রধান উপসর্গ হল ফুসকুড়ি ছাড়া চুলকানি, (সব আপনার শরীরের
উপর) এবং এটি সবচেয়ে বেশি গর্ভাবস্থার শেষ চার মাসে হয়। কারও কারও
চুলকানি ও বেশি ফুসকুড়িও হয়ে থাকে। কারও কারও ক্ষেত্রে চুলকানি অবিরাম বা
অসহনীয় হয়, আর রাতে বেড়ে যেতে পারে। মাঝে মাঝে চুলকানি আপনার হাতের এবং
আপনার পায়ের পাতার নিচের অংশে বেশী প্রখর হয়ে থাকে। অন্যান্য উপসর্গের
মধ্যে গাঢ় প্রস্রাব, জন্ডিস (ত্বক ও চোখের সাদা হলুদ), এবং কোষ্ঠকাঠিন্য অন্তর্ভুক্ত।
এসব লক্ষন দেখা দিলে দ্রুত ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করতে হবে।
নির্ণয় ও চিকিৎসা
সাধারনত
পারিবারিক ইতিহাস, এবং রক্ত পরীক্ষা করে আপনার লিভারের কার্যকারিতা
পরীক্ষার মাধ্যমে ওসি নির্ণয় করা হয়।রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে লিভারের ফাংশন
(LFT) এবং পিত্ত এসিডের মাত্রা পরীক্ষা করা হয়। একবার ওসি নির্ধারণ হওয়ার
পর, নিয়মিত LFTs পরীক্ষা করাতে হবে, আপনার শিশুর জন্ম না হওয়া পর্যন্ত।
আপনার LFTs এবং পিত্ত এসিড স্বাভাবিক হয় তারপরও আপনার তীব্র চুলকানি চলতে
থাকে, সেক্ষেত্রেও LFTs এবং পিত্ত এসিডের গতিবিধির উপর নজর রাখার জন্য
প্রত্যেক বা দুই সপ্তাহে পরীক্ষা করাতে হবে।
আপনার
ওসি থাকলে, আপনাকে ভিটামিন এর সম্পূরক দেওয়া যেতে পারে, যা আপনার ভিটামিন
“কে” এর শোষণ রোধ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সুস্থভাবে রক্তজমাট
বধতে সাহায্য করে।আপনার ওসি ধরা পরলে, আপনার ডাক্তার আপনার স্বাস্থ্য এবং
করনীয় নিয়ে আপনার সাথে আলোচনা করবেন।
COMMENTS