যেসকল উপসর্গ অবহেলা করা যাবে না গর্ভাবস্থা সম্পর্কে আপনি যতই পড়ে থাকুন কিংবা অন্য মায়েদের সাথে আলাপ করে থাকুন না কেন, আপনার নিজের ...
গর্ভাবস্থা
সম্পর্কে আপনি যতই পড়ে থাকুন কিংবা অন্য মায়েদের সাথে আলাপ করে থাকুন না
কেন, আপনার নিজের ৯ মাসে যা যা ঘটছে তার সবকিছুই স্বাভাবিক কি না সেটা বলা
কঠিন।
এখানে কিছু উপসর্গ নিয়ে কথা বলা
হচ্ছে যার কোনোটা দেখা যাওয়া মানেই বিপদের ঘণ্টা! যদি আপনি এই উপসর্গগুলোর
সামান্য উপস্থিতিও টের পান, তাহলে সাথে সাথে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন।
আপনার কিছুই ভালো লাগছে না
লক্ষণীয়
কোনো উপসর্গ না থাকা সত্ত্বেও আপনার কোনো কিছু ভালো লাগছে না, কিংবা
শারীরিকভাবে প্রচণ্ড অস্বস্তি লাগছে – যদি এমন হয়ে থাকে তাহলে নিজের
বিবেচনার ওপর আস্থা রেখে ডাক্তারের সাথে কথা বলুন। যদি আসলেই কোনো সমস্যা
হয়ে থাকে তাহলে তো তাৎক্ষণিক সেবা পাবেনই । আর যদি কোনো সমস্যা না থাকে
তাহলে হাসি মুখে বাড়ি ফিরে আসবেন।
আপনার
ডাক্তার কিন্তু চাইবেন যে আপনি এরকম ছোটোখাটো ব্যাপারেও যেন তাকে কল করেন,
এবং তিনি খুশিমনেই আপনাকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেবেন। আপনার মধ্যে এত দ্রুত
বিভিন্ন রকমের শারীরিক পরিবর্তন হচ্ছে যে সবকিছু ঠিক আছে কি না সেটা
অনেকসময়ই বোঝা মুশকিল হয়ে যায়।
পেট ব্যাথা
আপনার
পেটের উপরিভাগ বা মাঝ বরাবর যদি অসহনীয় ও খিঁচুনির মতো ব্যথা হয়, এবং সে
সাথে যদি বমি হয়, অথবা না ও হয়, তাহলে অন্য কোনো কারণেও এরকম হতে পারে।
আপনার বদহজম হতে পারে, কিংবা পেটের কোনো সমস্যা বা খাদ্যে বিষক্রিয়াজনিত
কারণেও পেটে ব্যথা হতে পারে। আর যদি এটা প্রি-এক্লেম্পশিয়ার লক্ষণ হয়, তাহলে দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা নিতে হবে।
আপনার
তলপেটের এক পাশে বা উভয় পাশেই প্রচণ্ড ব্যথা হলে তারও অনেকগুলো কারণ থাকতে
পারে। যেমন, কোনো লিগামেন্ট-এ টান পড়তে পারে, কিংবা আর যেসব সমস্যার কারণে
পেটে ব্যাথা হতে পারে –
- জরায়ুর বাইরে গর্ভধারণ
- গর্ভপাত
- অপরিনত প্রসব যন্ত্রণা
- কোনো ফাইব্রয়েড-এর বিকাশ ও রক্তক্ষরণ
- গর্ভফুল বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া
আপনার জ্বর হলে যদি তাপমাত্রা ৩৭.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে থাকে এবং কোনো সর্দি বা ঠাণ্ডা লাগার উপর্সগ না থাকে, তাহলে সেদিনই ডাক্তারের সাথে কথা বলুন।
যদি
তাপমাত্রা ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যায় তাহলে সাথে সাথে ডাক্তারকে কল
করুন। কোনো ধরণের সংক্রমণের জন্য এমন হতে পারে। ডাক্তার হয়তো আপনাকে
অ্যান্টিবায়োটিক খেতে দেবেন আর বিশ্রাম নিতে বলবেন। যদি দীর্ঘ সময়ের জন্য
শরীরের তাপমাত্রা ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে থাকে, তা আপনার গর্ভস্থ শিশুর
জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
দৃষ্টিশক্তির সমস্যা
যদি
দুই ঘণ্টার বেশি সময় ধরে সবকিছু জোড়া দেখেন, অস্পষ্ট বা ঝাপসা দেখেন,
কিংবা ফ্ল্যাশ লাইটের ঝলকানির মতো লাগে, তাহলে ডাক্তারকে জানান। এগুলো প্রি-এক্লেম্পশিয়ার লক্ষণ হতে পারে।
হাত-পা ফুলে যাওয়া
গর্ভাস্থায়
হাত, পা বা চোখ ফুলে যাওয়া (oedema) খুব সাভাবিক ঘটনা, ধারণত এতে চিন্তার
কিছু নেই। কিন্তু এটা যদি হঠাৎ করে তীব্র মাত্রায় হয় এবং সাথে আপনার মাথা
ব্যথা থাকে ও দেখতে সমস্যা হয়, তাহলে এটা প্রি-এক্লেম্পশিয়ার লক্ষণ।
যোনিপথ দিয়ে হাল্কা বা ভারী রক্তস্রাব
গর্ভাবস্থার
প্রথমদিকে যখন জরায়ুর গায়ে ভ্রুণ প্রোতিথ হয়, তখন হাল্কা রক্তস্রাব হওয়া
স্বাভাবিক। তারপরও গর্ভাবস্থায় যে কোনো সময় রক্তস্রাব হলেই ডাক্তারের সাথে
কথা বলে নেয়া ভালো, কারণ এটা হয়তো অনেক বড় জটিলতারও লক্ষণ হতে পারে।
–
আপনার স্বাভাবিক মাসিক স্রাব থেকে যদি এই রক্তস্রাব আলাদা হয় (হাল্কা,
ভারী বা বেশি গাঢ়) এবং সেই সাথে পেটের একপাশে ক্রমাগত অসহনীয় ব্যথা হয়
তাহলে এটা জরায়ুর বাইরে গর্ভধারণ হবার লক্ষণ (Ectopic Pregnancy)।
– পিঠে বা পেটে একটানা ব্যথার সাথে সাথে যদি ভারী রক্তস্রাব হয়, তাহলে গর্ভপাতের সম্ভাবনা আছে বা গর্ভপাত হতে যাচ্ছে।
–
গর্ভাবস্থার শেষের দিকে রক্তস্রাব হলে তা নির্দেশ করতে পারে যে গর্ভফুলটি
নেমে গেছে বা জরায়ু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে যা নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগে
(৩৭ সপ্তাহ হবার আগেই) থেকেই প্রসব যন্ত্রণা তৈরি করতে পারে।
যোনিপথে গর্ভজল বের হয়ে যাওয়া
৩৭ সপ্তাহ
হবার আগেই গর্ভজল বের হতে শুরু করা মানে আপনার গর্ভঝিল্লি অনেক আগেই ছিদ্র
হয়ে গেছে। এই অবস্থায় ডাক্তার আপনাকে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যেতে বলবে যাতে
করে কোনো সংক্রমণ হওয়া রোধ করা যায় এবং সময়ের আগেই বাচ্চা প্রসব করাতে হলে
আগে থেকেই প্রস্তুত থাকা যায়।
৩৭
সপ্তাহ হয়ে যাবার পর আপনার এমনিতেই প্রসব যন্ত্রণা শুরু হয়ে যাবার কথা। যদি
২৪ ঘন্টার মধ্যে প্রসব যন্ত্রণা শুরু না হয় তাহলে আপনার ডাক্তারের সাথে বা
লেবর ওয়ার্ডে যোগাযোগ করে কি করবেন জেনে নিন।
হঠাৎ তৃষ্ণা বেড়ে যাওয়া
যদি হঠাৎ করে আপনার ক্রমাগত পানির পিপাসা পায়, কিন্তু সে অনুপাতে প্রস্রাব না হয়, তাহলে পানিশূন্যতা বা গর্ভকালীন ডায়াবেটিস এর লক্ষণ হতে পারে। উভয় ক্ষেত্রেই আপনার ও গর্ভস্থ শিশুর জটিলতার ঝুঁকি আছে।
প্রস্রাবের সময় জ্বালাপোড়া
প্রস্রাবের
সময় যদি প্রস্রাবের রাস্তায় জ্বালাপোড়া করে এবং সাথে জ্বর জ্বর ভাব,
কাঁপুনি আর পিঠে ব্যাথা থাকে তাহলে বুঝতে হবে আপনার ইউরিনারি ট্র্যাক্ট
ইনফেকশন আছে। আপনার ডাক্তারের সাথে কথা বলুন, তিনি আপনাকে কিছু
অ্যান্টিবায়োটিক দিতে পারবেন।
অতিরিক্ত বমি
দিনে দুইবারের বেশি বমি হলে আপনি পানিশূন্য ও দুর্বল হয়ে যেতে পারে, যদিও তাতে আপনার বাচ্চার কোনো ক্ষতি হবে না। অতিরিক্ত পরিমাণ ও একটানা বমি হলে (hyperemesis gravidarum) ডাক্তারের সাথে কথা বলুন, কারণ আপনার হয়তো হাসপাতালেও ভর্তি হওয়া লাগতে পারে।
গর্ভাবস্থার
শেষের দিকে পাঁজরের নিচে প্রচণ্ড ব্যাথার সাথে সাথে যদি বমি হয়, তাহলে
প্রি-এক্লেম্পশিয়ার লক্ষণ হতে পারে। বমির সাথে সাথে যদি পেটে ব্যাথা আর
উচ্চ তাপমাত্রা থাকে, তাহলে কোনো ইনফেকশনও থাকতে পারে। যেটাই হোক না কেন,
ডাক্তারের সাথে কথা বলুন।
অজ্ঞান হয়ে যাওয়া বা মাথা ঘোরা
অজ্ঞান
হয়ে যাওয়া বা মাথা ঘোরানোর মানে হতে পারে যে সেদিন আপনি যথেষ্ট খাওয়া-
দাওয়া করেননি, আবার এটাও হতে পারে যে আপনার রক্তচাপ কমে গেছে। গর্ভাবস্থায়
অনেক মহিলারই মাথা ঘোরায়। যদি অজ্ঞান হয়ে যান, তাহলে জ্ঞান ফিরবার পর
ডাক্তারের সাথে কথা বলে নিশ্চিত হয়ে নিন সবকিছু ঠিক আছে কি না।
বাচ্চার নড়া-চড়া শিথিল হয়ে যাওয়া
২১
সপ্তাহের পর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যদি আপনার গর্ভস্থ শিশুর নড়া- চড়া ধীর হয়ে
যায় বা একদমই না হয় তাহলে বুঝতে হবে বাচ্চার কোনো সমস্যা হয়েছে। যদি আপনি
খেয়াল করেন যে আপনার বাচ্চা অন্য সময়ের চেয়ে কম নড়া- চড়া করছে, তাহলে
ডাক্তার বা হাসপাতালে যোগাযোগ করুন। বাচ্চার নড়া- চড়া সম্পর্কে আরও পড়ুন
এবং জানুন কখন সাহায্য চাইবেন।
গর্ভাবস্থার শেষের দিকে সারা গায়ে চুলকানি
যকৃতের
কোনো জটিলতার জন্য এমন হতে পারে, যেমন Obstetric Cholestasis (OC)। আপনার
যদি OC হয় তাহলে আপনার জন্ডিসও হতে পারে, সেই সাথে গাঢ় বর্ণের প্রস্রাব আর
ফ্যাকাশে পায়খানা।
যেহেতু বাচ্চার
বিকাশের সাথে সাথে আপনার ত্বকও বিস্তৃত হচ্ছে, কিছু কিছু চুলকানির ভাব
স্বাভাবিক। তারপরও একবার পরীক্ষা করিয়ে নেয়া ভালো, বিশেষ করে যদি পায়ের
পাতার নিচের অংশে আর হাতের তালুতে তীব্র চুলকানি হয় আর রাতের বেলা সেটা আরও
বেড়ে যায়।
পড়ে যাওয়া বা পেটে ধাক্কা খাওয়া
পড়ে
যাওয়া বা পেটে ধাক্কা খাওয়া সবসময় বিপজ্জনক নয়, তারপরও যদি এমন কিছু হয়
তাহলে সেদিনই ডাক্তারকে ফোন করে জানান কি হয়েছে। যদি আপনি সিঁড়িতে হোঁচট
খেয়ে পড়ে যান এবং পুচ্ছাস্থিতে (tailbone) ব্যথা পান, তাহলে চিন্তার কিছু
নেই। আপনার বাচ্চা জরায়ু আর অ্যামনিয়টিক তরল দ্বারা সুরক্ষিত আছে।
তবে
কখনো কখনো জটিলতা তৈরি হতেও পারে। যদি আপনি সঙ্কোচন বোধ করেন, কিংবা
গর্ভজল বের হয় বা রক্তস্রাব হয়, তাহলে সাথে সাথে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ
করুন এবং নিকটস্থ চিকিৎসা কেন্দ্রে যান।
দীর্ঘ
নয়মাস গর্ভধারণের কষ্টগুলো একরাশ আনন্দে পরিণত হয় নিরাপদে সুস্থ্য বাচ্চা
জন্ম দেবার মধ্য দিয়ে। নিজেকে এবং গর্ভের শিশুকে নিরাপদ রাখার জন্য সচেতন
হতে হবে আপনাকে এবং আপনার স্বামীকেও। তাই এই আর্টিকেল-এ উল্লেখ করা বিষয়
গুলো নোট করে রাখুন। আর শেয়ার করুন আপনার পরিচিত গর্ভবতি মায়েদের সাথে।
COMMENTS